মনযূরুল হক
ধর্ম বড় নাকি মানবতা— এই প্রসঙ্গে আমার স্পষ্ট বক্তব্য হলো, ধর্মের চাইতে মানবতাই বড় । এ ক্ষেত্রে সাধারণ যুক্তি হলো— আগে মানুষ এসেছে এবং তার পরে তাকে বিধান দেয়া হয়েছে; আগেই বিধান নাজিল করে রাখা হয় নি । আর গভীর কথাটা হলো— আমি যদি নিজেকে মুসলিম বলি, তাহলে হয়তো আমি পৃথিবীর ১৫০ কোটি মানুষকে সাথে পাবো । কিন্তু আমি যদি বলি আমি মানুষ, তাহলে বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষ বা পৃথিবীর তাবৎ জনগোষ্ঠীর কথাই আমার বলা হবে । আমার কাছে ১৫০ কোটির চেয়ে অবশ্যই ৭০০ কোটির স্বার্থ বড়— এখানে ধন্দের কী আছে ! এর মানে কি মানবতার জন্যে আমি ধর্ম ছেড়ে দেবো ? কিংবা মানবতা ও ধর্মের যখন দ্বন্দ্ব হবে, তখন কি আমি ধর্ম বাদ দিয়ে মানবতা গ্রহণ করবো ? কেউ আগ বাড়িয়ে হয়তো বলেও ফেলবেন— আপনি কি নাস্তিক ? ধর্মে বিশ্বাস করেন না ? তবে মূল প্রশ্নটা শুনতে কিন্তু যতো জটিল মনে হয়, আসলে ততোটা জটিল নয় ।
কেননা, মানবতাকে বড় রাখতে গিয়ে আমাকে কখনোই ধর্ম ত্যাগ করতে হবে না । কেননা, আমার মতে, সত্যিকারের কোনো ধর্মে এমন কোনো বিধান থাকতে পারে না, যা মানবতার খেলাফ— অমানবিক । এখানে যুক্তি হলো, সব ধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাস একটাই— যিনি তাদের বিধান দিয়েছেন, তিনিই মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন । সুতরাং মানবের জন্যে কোনটা ভালো, এটা তার চেয়ে ভালো আর কে জানে ? যেমন— কোরআনে বলা হয়েছে, “কোরআন তার পক্ষ থেকেই অবতীর্ণ হয়েছে, যিনি সু্উচ্চ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন ।” (২০ : ৪)
এখনই প্রশ্ন আসবে, তাহলে আমি ইসলামকে কেনো মানছি, অন্য ধর্মও তো গ্রহণ করতে পারতাম ? তারও আগের প্রশ্ন হলো, ধর্ম বড় নাকি মানবতা, কেনো এই প্রশ্ন উঠলো ? আগের প্রশ্নের উত্তর আগে বলি । ধর্ম বড় নাকি মানবতা, এই প্রশ্ন এ জন্যেই উঠেছে, যখন আমরা দেখবো কোথাও মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে এবং ধর্মের নামে সেটা চাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে, ‘মানবতা বড়’ এই কথাটা যদি তখন আমাদের মাথায় থাকে, তাহলে সহজে বুঝে নিতো পারবো যে, ধর্মের কোথাও বুঝতে ওদের ভুল হচ্ছে । যেমনটা ঘটেছিলো হিন্দুদের সতীদাহ প্রথার বেলায় । রাজা রামমোহন রায়কে ধন্যবাদ ।
একই সঙ্গে ধর্ম নাকি মানবতা এই আলোচনা এ জন্যেও দরকার, যেহেতু অনেকেই আজকাল ঐকতানে বলছেন ধর্মমুক্ত মানববাদের কথা । কারণ তাদের মতে, ধর্মের কারণেই মূলত দ্বন্দ্বটা তৈরি হয়, আর এই দ্বন্দ্বের কারণেই মানবজাতির মধ্যে ধর্মযুদ্ধ হয়েছে সবচে’ বেশি এবং পৃথিবীতে সবচে’ বেশি নিহত হয়েছে মানুষ ধর্মযুদ্ধে । ধর্ম থাকলে দ্বন্দ্বটা তৈরি হবেই । কেননা, প্রত্যেকেই মনে করে তার ধর্মই বেস্ট । সুতরাং অন্য ধর্ম না মেনে আমি ইসলাম কেনো মানছি, সেই প্রশ্নের উত্তর এখন বের হয়ে এসেছে । অর্থাৎ ইসলাম আমি এ জন্যেই মানছি, কেননা, ইসলামই আমার কাছে বেস্ট ।
গত ২৭ আগস্ট MOVE Foundation-এর কর্মশালায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাংবাদিক রাহাত মিনহাজও ‘দ্বন্দ্ব ও বাক-স্বাধীনতা’ বিষয়ক আলোচনায় দ্বন্দের মূলকারণ বোঝাতে গিয়ে একই যুক্তি তুলে ধরেছেন যে, দ্বন্দ্বটা এ জন্যে তৈরি হয়, কেননা, প্রত্যেকেই মনে করে তার ধর্মই বেস্ট । আমি প্রশ্ন করেছিলাম— স্যার, যদি আমি আমার ধর্মকে বেস্ট মনে না করি, তাহলে আমি সেটা কেনো গ্রহণ করবো ? তিনি কোনো জবাব দেন নি ।
আসল কথা হলো, প্রত্যেকেই তার ধর্মকে বেস্ট মনে করার কারণে মূলত দ্বন্দ্বটা তৈরি হয় না । বরং দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, আমার কাছে যেমন আমার ধর্মটা বেস্ট তেমনি তার কাছেও তো তার ধর্মটা বেস্ট— এই মনোভাব পোষণের অভাব থেকে । আমার মতো তার ধর্মও তার কাছে বেস্ট— এই মনোভাব যদি আমরা লালন করতে পারতাম, তাহলে অপরের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কসুর হতো না । দ্বন্দ্বটাও বাঁধতো না । ইসলাম এ জন্যেই দাওয়াতের বেলায় নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছে যে, ‘উদউ ইলা সাবিলি রব্বিকা বিল হিকমাতি অল-মাওয়িজাতিল হাসানা’ (১৬ : ১২৫) অর্থাৎ অপরকে দাওয়াত দিতে হলে বুদ্ধিমত্তা ও সুন্দর কথার মাধ্যমে দাওয়াত দিতে হবে । আপনি যদি কাউকে বলেন, আপনার ধর্ম ভালো নয়— দ্বন্দ্ব তখনই বাঁধবে ।
আর ‘ধর্মযুদ্ধ’ বলতে আধুনিক পরিভাষায় যেটা বোঝানো হয়, অর্থাৎ এক ধর্মের বিরুদ্ধে আরেক ধর্মের যুদ্ধ— সেটা আদৌ ইসলাম সমর্থন করে না এবং কোনো ধর্মই সেটা সমর্থন করতে পারে না । কেউ হিন্দু-খ্রিষ্টান বা অন্য কোনো ধর্মের হলেই তাকে আঘাত করা যাবে, এই নীতি কি কোনো ধর্মের হতে পারে ? পারে না । কেননা, ধর্মের চেয়ে বড় পরিচয় মানুষ, ভিন্ন ধর্ম হলেও সেটা তো সে ধারণ করে আছে । কোরআন বলেছে— ‘লা ইকরাহা ফিদ দীন’ (২ : ২৫৬) অর্থাৎ ইসলামে কাউকে জোর করে আনা যাবে না । কাউকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা যাবে না । যে যে-ধর্মেরই থাকুক, তারা নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করতে পারবে ।
প্রশ্ন আসবে তাহলে জিহাদ কী ? জিহাদ কি ইসলামের ধর্মযুদ্ধের নাম নয় ? এর উত্তর সরাসরিই বলা যায়— না, জিহাদ কোনো ধর্মযুদ্ধ নয় । জিহাদ হলো অবিচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, মানবতার প্রয়োজনে যুদ্ধ । সারা পৃথিবীর মানুষ, সে যে ধর্মেরই হোক না কেনো, ইসলাম তাকেও এই যুদ্ধের পথে আহ্বান করে, অবিচারের বিরুদ্ধে লড়তে বলে । আমরা দেখেছি— নবি মুহাম্মাদ স. মক্কা বিজয়ের আগে ও পরের কয়েকটি যুদ্ধে অমুসলিমদেরও সাথে নিয়েছিলেন । মক্কা বিজয়ের প্রেক্ষাপটের দিকে আমরা লক্ষ করি । ‘বনু খুজায়া’ নামের একটি অমুসলিম গোত্রের উপর রাতের আঁধারে ‘বনু বকর’ নামের আরেকটি অমুসলিম গোত্র আক্রমণ করে কয়েকজনকে হত্যা করেছে এবং বনু খুজায়া এসে মুসলিমদের কাছে নালিশ করে এর প্রতিবিধান চেয়েছে, যেহেতু তারা মুসলিমদের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিলো । মুহাম্মাদ স. মক্কার মুশরিক কোরাইশদের বলছেন এর প্রতিবিধান করতে, যেহেতু বনু বকর ছিলো কোরাইশদের সাথে চুক্তিবদ্ধ এবং কোরাইশ নিজেও এই আক্রমণে আঁতাত দিয়েছে বলে পরিষ্কার তথ্য পাওয়া গেছে । কিন্তু কোরাইশ নেতৃবৃন্দ এর প্রতিবিধান করতে অস্বীকার করেছেন এবং মুসলিমগণ কোরাইশের এই অবিচারের বিরুদ্ধে, যেই অবিচার করা হয়েছিলো একদল অমুসলিমের ওপর, সেই অবিচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং এই অভিযানের মাধ্যমেই মক্কা বিজয় সূচিত হয়েছে । ইতিহাস জানাশোনা সবাই জানেন, এই বিজয়ের সময় কোনো অমুসলিমের ওপর আক্রমণ করা হয় নি এবং বনু খুজায়াকে ন্যায়সঙ্গতভাবে ‘প্রতিবিধান’ বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে । এখানে কিন্তু ধর্মের বিবেচনার চেয়ে মানবতাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে ।
আমরা মনে করি, বিশ্বের সব ধর্মের ও বর্ণের মানুষ যদি শুধু অবিচারের বিরুদ্ধে একাট্টা থাকতো, তাহলে কখনো জিহাদ ও যুদ্ধ শব্দ দুটিকে আলাদা করে বোঝার প্রয়োজন হতো না । এবং আমরা এটাও জানি, কোনো ধর্মই অন্যায়কে সয়ে নিতে বলা হয় নি, বরং অন্যায়কে রুখে দিতে বলা হয়েছে । এমন কি কখনো হতে পারে যে, অন্যায়টা একেক ধর্মে একেক রূপ নিয়ে আছে ? অর্থাৎ ইসলামের চোখে যেটা অন্যায় এবং এমন অন্যায় যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে, কিন্তু অন্য ধর্মের চোখে সেটাই ন্যায়সঙ্গত ? ধর্মানুসারীদের অ্যাক্টিভিটি দেখে বিচার করলে চলবে না, বরং ধর্মে কী বলা আছে, সেটাকেই বিবেচনায় আনতে হবে । উদাহরণ স্বরূপ— গুজরাটে যে ব্যাপকহারে মুসলিম নিধন হলো, সেটা ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায় । কিন্তু সেটা কি হিন্দু ধর্মে অন্যায় নয় ? অবশ্যই অন্যায় । যদিও উগ্র হিন্দুরা সেটা ধর্মের কাজ বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছে । একইভাবে অর্টিজেনে যে ছেলেরা খ্রিষ্টান ও হিন্দুদের নৃশংসভাবে হত্যা করলো, সেটা অবশ্যই হিন্দু ও খ্রিষ্টান ধর্মের মতে অন্যায় । ইসলাম ধর্মমতে কি সেটা অন্যায় নয় ? অবশ্যই অন্যায় । যদিও উগ্র মুসলিমরা সেটা ধর্মের কাজ বলে আখ্যা দিয়েছে ।
বোঝা গেলো, অন্যায় সব ধর্মের চোখেই অন্যায় এবং মানবিকতা সব ধর্মের চোখেই সমান । ধর্মের ভেতরকার পার্থক্য কেবল দুটি বিষয়ে । একটি হলো তাদের ঈশ্বর বিশ্বাস; সেটা হতে পারে দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্য । আরেকটি হলো, তাদের ইবাদত ও অর্চনার পার্থক্য । সামাজিক ও বৈশ্বিক ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নে ধর্মগুলোর মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য আদতেই নেই । তাহলে আমরা এবার প্রশ্ন করি, যারা ধর্মমুক্ত মানববাদের কথা বলেন, তারা মানবতাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করতে চান ? আমরা দেখেছি, তারা নানা ধর্মের অনুসারীদের বিভিন্ন স্খলন নিয়ে সোচ্চার থাকেন; প্রকৃত অর্থে যেগুলো ধর্মের ত্রুটি নয় । এভাবে আসলে তারাই কি দ্বন্দ্বটা উস্কে দিচ্ছেন না ? অবশ্য আমার মনে হয়, এটা করে তারা ধর্ম-অনুসারীদের একরকম উপকারও করছেন । কেননা, এর ফলে ধর্মবেত্তারা তাদের অনুসারীদের ভুল-চুক সম্পর্কে আরও বেশি ওয়াকিবহাল হতে পারছেন এবং ধর্মের প্রকৃত মর্ম জানতে তারা আরও বেশি গবেষণা করছেন । ফলে আমরা দেখি, পৃথিবীতে ধর্মমুক্ত মানুষের সংখ্যা যতো বাড়ছে, ধর্মের প্রতি অনুরাগীর সংখ্যা বাড়ছে তার চেয়ে বহু বহুগুণ বেশি ।
সবিশেষ— অর্টিজেনে হামলার পরে স্পষ্টতই সবাই একসুরে বলছেন, ধর্মীয় পড়াশুনার অভাবেই ছেলেগুলোকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হয়েছে । অর্থাৎ ধর্মের সঠিক জ্ঞান থাকলে এমন অমানবিক কাজ তাদের দিয়ে হতো না । বোঝা যায়, কেবল ধর্মের সঠিক বোধ ও অনুশাসনের মাধ্যমেই মানুষ সত্যিকারের মানবিক হতে পারে । সুতরাং ধর্মের চেয়ে মানবতা বড় হলেও মানবতা শেখার জন্যে ধর্মের চেয়ে বড় আর কিছু নেই ।
[বি.দ্র. মুভ ফাউন্ডেশনের কর্মশালায় রাহাত মিনহাজ স্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছিলেন যে, সারা বিশ্বে ইসলামই কেনো বারবার আক্রান্ত হচ্ছে ? দুইভাবে ইসলাম আক্রান্ত হচ্ছে, ইরাক-আফগান-ফিলিস্তিনের মতো বহু মুসলিম দেশ ও মুসলিম জনগোষ্ঠী আক্রান্ত এবং বিভিন্ন মুসলিম গ্রুপ জিহাদের নামের বিচ্ছিন্ন হামলা চালাচ্ছে; যার ফলে আক্রান্ত নয় এমন মুসলিম দেশ এবং অমুসলিম দেশে বসবাসকারী শান্তিপ্রিয় মুসলিম জনসাধারণ অপমানিত হচ্ছেন । কিন্তু সময়ের অভাবে সেদিন এ নিয়ে আলোচনা করা যায় নি । আমার মনে হয়, এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা সময়ের দাবি এবং সেই আলোচনার মধ্য দিয়েই ‘ইসলাম কেনো বেস্ট’ সেটা উঠে আসতে পারে ।]