মনযূরুল হক
এক.
মোহিত কামালের একটা উপন্যাস পড়েছিলাম, ‘না’ । বহুদিন আগে । একটা মেয়ে কিভাবে না বলতে না পেরে ধীরে ধীরে দুষ্টচক্রের ফাঁদে পড়ে যায় । লেখক উপন্যাসটা লিখেছেন হোস্টেলের মেয়েদের উপহারের লোভে পড়ে নানান অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার কাহিনীকে ভিত্তি করে । কিন্তু এর যে একটা গূঢ় অর্থও আছে, সেটা সাধারণ সব পাঠক টের পাবেন না নিশ্চিত । যেমন আমরা পাই না । আমার সামনে আমার বন্ধু দেদার মিথ্যা বলে যাচ্ছে, আমি দেখছি, বুঝছি, শুনছি— কিন্তু না বলতে পারছি না । আবার অনেক ক্ষেত্রে সায় দিয়ে বিষয়টাকে আরও ফাঁপিয়ে তুলছি । ক্রেডিট নিচ্ছি । এবং এভাবে আমিও যখন আড্ডার তুমুল সরগরমে ভুলভাল বকে নিজেকে হাইপথেটিক প্রমাণের চেষ্টা করছি, তখন সেই বন্ধুও আমার কথায় তাল দিয়ে পূর্বের অপরিশোধিত ঋণ পরিশোধ করছেন; কৃতজ্ঞ বন্ধুত্বের প্রমাণ দিচ্ছেন ।
একই রকম ঘটনা শিক্ষক কিংবা মুরব্বিদের বেলায়ও ঘটে । ক্লাসে ভুল পড়াচ্ছেন শিক্ষক এবং সেই ভুলকে সঠিক প্রমাণ করতে ক্রমাগত ভুলের ওপর ভুল থিউরি কপচে জল-কাদায় একাকার করে ফেলছেন— বুঝছি, বলছি না । মজলিসে মুরব্বিরা ভুল সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় । না জানা থেকেও হতে পারে, কিংবা দু’পয়সা ঘুষ নিয়েও করে থাকতে পারেন । কিন্তু আমরা একটা ফার্সি প্রবাদের দোহাই দিয়ে সরে পড়ছি— বড়দের ভুল ধরাও ভুল (খতায়ে বুযুর্গাঁ গেরেফতান খতা) । এভাবে একটা ভুলের ওপর দাঁড়িয়ে গোটা সিদ্ধান্তের ঝোলাটা চাপিয়ে দেয়া হয় কোনো অবলার ঘাড়ে । সমাজের অপমান থেকে বাঁচতে গুমরে কেঁদেই তিনি বাকি জীবনটা পার করেন ।
আমাদের রাজনীতিকরা এই কর্মটা করেন সবচে’ বেশি । তোষামুদে কৌশল জানা না থাকলে রাজনীতিতে হাত পাকানো যায় না । হ্যাঁ-হ্যাঁ জিগির তুলে দলান্ধতার বিরাট নজির সৃষ্টি করে তারা দেশের হর্তা কর্তা হয়ে বসেন । নেত্রীর তোয়াজ করেন সভাসদরা । সভাসদদের তোয়াজ করেন চামুণ্ডারা । চামুণ্ডারা উঠে আসে ছাত্র কিংবা যুব সমাজ থেকে, তাদেরকে বড়ভাই বলে তোয়াজ করে ক্ষুদে পাণ্ডবরা— একটা দলের মধ্যে কাউকে পাওয়া যায় না নিজ দলের ভুলটা আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেবার । ফলে মূর্খতার জয়জয়কার হয়, দলের শিক্ষিতরাও কখনো আর জ্ঞানী হয়ে ওঠার সুযোগ পায় না ।
দুই.
দ্বিতীয় দিকটি হলো, আক্ষরিক অর্থে স্বজনপ্রীতির কারণে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া । ছেলে খুন করে এসেছে, বাবা ছেলেকে চোখের সামনে ফাঁসি হতে দিতে পারেন না । অথচ তিনি পরহেজগার মানুষ । তবু তিনি নিজের সর্বস্ব দিয়ে ছেলেকে বাঁচানোর তদবির শুরু করেন । নিজে মিথ্যা সাক্ষী দেন । অন্যদের দিয়ে দেওয়ান । ‘না, এ অন্যায়’ বলে ছেলেকে পুলিশের হাতে সঁপে দেয়ার কথা ভাবেন না একবারও । আর পুলিশ তো পুলিশ । তারাও অযাচিতে বাবার ‘দান’ হাতে পেয়ে অস্বীকার করেন কী করে ? সুতরাং তাদের মুখে ‘না’ ফোটে না । এই বিষ ক্রমশ দেশের সর্বোচ্চ শক্তিমান প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রিয়াশীল হতে থাকে । বিচারকরাও ‘হ্যাঁ’ বলে হাত বাড়িয়ে দেন । সংবাদ কর্মীরা চাকরি বাঁচাতে গিয়ে ‘না’ বলতে ভুলে যান । আমাদের পর্লামেন্টে মিথ্যা যুক্তি দিয়ে সেই না কে হ্যাঁ করার নির্মম চেষ্টা চলে । তারপরও যদি কোনোমতে বাহাদুর ছেলে ফেঁসে যায়, তাহলে রাষ্ট্রপতি মার্সি দিয়ে এইট মার্ডারের আসামিদেরও ‘হ্যাঁ’ বলে দেন । অপরাধী ছেলে তখন নিজেও সংশয়ে পড়ে— আসলেই কি খুনটা আমি করেছিলাম?
কিংবা ঠিক উল্টোটাও কল্পনা করুন । খুনটা ছেলে করে নি, কিন্তু তাকে ফাঁসানো হয়েছে । সরকার, আইন, প্রশাসন, বিচার, গণমাধ্যম একযোগে লেগেছে তাকে ফাঁসি দিতেই হবে । তো সর্বশেষ রাষ্ট্রপতিও আর তাকে মার্সি দিতে রাজি হন না । এমন নজিরও আমাদের সমাজে একেবারে কম নেই ।
অনুরোধে ঢেকি গেলা থেকেও এই ‘না’ বলার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেন না অনেকেই । আপন মানুষ, ভালো কাজ জানে, বিনেপয়সায় কাজটা আদায় করা যায় কি না দেখি । আবার যাকে কাজটা দেয়া হলো, তিনিও দীর্ঘদিনের পরিচিত, কিছু উপকারও অল্প-বিস্তর তার মাধ্যমে হয়েছে । এখন না করি কী করে? শেষমেশ কাজটা ঝুলে থাকে বহুদিন । মূল ভোক্তারা ভোগান্তিতে পড়েন । নিজের ক্যাপাবিলিটিও বদনামের মুখে পড়ে । সম্পর্কও নষ্ট হয় ।
তিন.
আরেকটা সমস্যা হলো, আমরা যখন কোনো আর্টিকেল পড়ি, কিংবা কোনো তথ্যভিত্তিক লেখা পড়ি, ভাবি— বেশ ভালো বলেছেন । বুঝতে চেষ্টা করি না, কতটুকু হ্যাঁ, আর কতটুকু না । অনেক ক্ষেত্রে রেফারেন্স থাকে না । আবার রেফারেন্স দেয়া থাকলেও সেটা আসলে সঠিক রেফারেন্স কি না, তা ঘেঁটে দেখার সময় কই? অথচ যদি আমি এখান থেকে কিছু নিতে চাই, তাহলে অবশ্যই এই লেখাকে প্রথমে আমার নাকচ করা উচিত । তারপর প্রতিটি সূত্র বুঝে এগোতে হবে । খুঁজলে দেখা যাবে, কয়েকটা আমার জন্যে ‘না’ হয়ে গেছে । যদি দেখা যায়, সবগুলো চলনসই, কেবল তখনই আমরা লেখাটি হ্যাঁ বলতে পারি, নয়তো যেগুলো ‘না’ সেগুলো থাকার পরেও কী করে আমি অবলীলায় হ্যাঁ বলে দেবো? শোনাকথা রেফারেন্স হিসেবে বলে দেয়ার কারণেও বিভক্তির তৈরি হয় । ধর্মীয় বিভক্তির গোড়াও এখানেই । অথচ ধর্মের ক্ষেত্রে সবচে’ বেশি সচেতন হওয়া দরকার ছিলো । সেটা হয় নি ।
আবেগ ও অনুসন্ধিৎসু মনের অভাব আমাদের এই জাতির সবচে’ বড় সমস্যা । ধর্মান্ধতাও মূলত এই অনুসন্ধিৎসু মনের অভাব থেকেই তৈরি । এর থেকেই তৈরি হয়, মূর্খতা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর কুসংস্কার । কেউ একজন ওয়াজ করে গেলেন, আমরা ভাবালু হয়ে পড়ি, না, সেটাকে নিয়ে গবেষণায় বসি না, বরং তার সম্মোহনে আকৃষ্ট হয়ে অন্যের গবেষণাপ্রসূত হ্যাঁকে না করতে লেগে যাই, আবার আরেকদিন আরেক ওয়াজের ওয়াজ শুনে একই দশা হয় আমাদের, ততদিনে আগের ওয়ায়েজের ওয়াজ ভুলে যাই ।
আমি একজনের সঙ্গে তর্ক করছি । বলছি— অমুক লোকটি ভালো নয় । তাকে ভালো নয় বলছি, কেননা, আমি তার সাপোর্টার নই । একই সঙ্গে তার মন্দগুলো বলছি স্রেফ শোনাকথা দিয়ে । আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমি যে এতগুলো মন্দ তার সম্পর্কে বললাম, অথচ বিপরীতপক্ষ আমার কাছে একটারও রেফারেন্স চায় নি । বরং আমি যার সাপোর্টার, উল্টো সে তার দোষ বর্ণনা শুরু করেছে । আমিও বিপরীতপক্ষের কাছে রেফারেন্স চাই নি । সুতরাং ফলাফলে দেখা যায়, হয়তো দুজনেই দুইজন অচেনা মানুষের প্রতি বিদ্বেষ নিয়েই ফিরছি । অর্থাৎ এই তর্কের কোনো সমাধান হলো না । তার চেয়েও গভীর কথা হলো, আমি যাকে সাপোর্ট করি, তার প্রতিও আমার এক ধরনের বীতশ্রদ্ধ মনোভাব তৈরি হয়েছে, অপরের মুখে তার দোষ শুনে শুনে । এই ধরনের বিভক্তির সুরাহা কী করে হবে ?
পুলিশ পরিচয়ে এসে গ্রেপ্তার হয়ে কিংবা গুম হয়ে যাওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধির এটা অন্যতম কারণ । পুলিশ শুনেই সুরসুর করে তার সাথে থানায় চলে যাচ্ছে । একবারও পুলিশকে জিজ্ঞেস করা হয় নি, কোন আদেশ বলে তাকে ধরে নেয়া হচ্ছে । থানায় যাওয়ার পরও আইনি সহায়তার পাবার তার রাষ্ট্রীয় অধিকার আছে, কিন্তু সাহস হয় নি ।
চার.
হ্যাঁ, এটাই হলো, আসল কথা— ‘না’ বলতে সাহস লাগে । কেননা, ‘না’ প্রতিবাদের শব্দ, দ্রোহের শব্দ । অপরদিকে ‘হ্যাঁ’ হলো, চাটুকারিতার শব্দ, রসের শব্দ ।
অন্যদিগন্তে জনৈক লেখকের জাপান ভ্রমণ কাহিনীতে পড়েছি— জাপানিরা নাকি না বলতে জানে না । সবকিছুকে তারা হ্যাঁ দিয়ে চালিয়ে দিতে চায় । হতে পারে, তাদের ভেতরে নেগেটিভ সেন্স কম । যেহেতু তাদের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় ভুলের স্তর পাহাড়সম হয়ে ওঠে নি । তাদের দেশে দুর্নীতির সূচক বিশ্বের চ্যাম্পিয়ন হবার স্বপ্ন দেখায় নি । তবে আমাদের দেশের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে পূর্বাপর যেটুকু অর্জন আমাদের আছে, তা সবই এসেছে ‘না’ বলতে পারার বদৌলতেই । ৫২-তে যখন ঘোষণা এলো— পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা । তখন আমাদের তরুণরা গর্জে উঠেছিলো— না, এটা হতে পারে না (no, it can’t be)।
ব্লগার Arif R Hossain ভাই বলেছিলেন— আমাদের রক্তের একটা কমন গ্রুপ হলো সি পজিটিভ (see positive); অর্থাৎ সবকিছু হ্যাঁ করে দেখার প্রবণতা । মাইনুল শাহিদ ভাই বলেছিলেন— আদম আ.-কে গন্ধম খেতে নিষেধ করা হয়েছিলো, তিনি কিন্তু এই না-কে না করে খেয়েছেন । এর ফলেই পৃথিবীর সৃষ্টি, জ্ঞানের সূচনা ।
না বলা মানে তর্কের সূচনা— এটা সত্য এবং আমাদের তর্কের প্রয়োজনও আছে বটে, যদি বিবাদ না হয় । তবে আমাদের উদ্দেশ্য হলো, না বলে সবক্ষেত্রকে প্রত্যাখ্যান করা নয়; বরং আপাত অর্থে না মানে নাকচ করা । এটা কেবলই অনুসন্ধানের প্রয়োজনে । অনুসন্ধানের পর হ্যাঁ বলে মেনে নেয়া গেলে, সেটা না মানার আর কোনো কারণ নেই । যেমন— কোরআনেও আগের ধর্মকে ‘না’ বলা হয়েছে, এরপর কিন্তু পূর্বের ধর্মের বহুরীতি আবার অন্তর্ভুক্তও করা হয়েছে এই ধর্মের রীতি হিসেবে । একইভাবে পূর্বসূরি বড়দের অনেক নীতিমালা আমরা না করতে চাই, যেনো ভালো করে বুঝে নিতে পারি, কতুটুকু আমাদের জন্যে প্রযোজ্য, আর কতটুকু নয়; যেমন— তারা তাদের পূর্ববর্তীদের নীতিমালা না করেছিলেন । পূর্বের কেউ করে গেছেন বলে আমার করবো, এটা হতে পারে না । এমন কথা বলেছিলো মক্কার কোরাইশ কাফেররা । আমরা কাফেরদের অনুসরণ করতে পারি না ।
Leave a Reply